বাংলাদেশে বোম্বে
Author: রক্তবন্ধু | 22 Mar 2023
বোম্বে নিয়ে বিশাল যজ্ঞ
২০মে, ২০১৬ সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন আরিনোবা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কর্মকর্তা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।
২১মে ভর্তি করা হয় রাজধানীর স্বনামধন্য হাসপাতাল অ্যাপোলোতে। তার বাম পা, বাম হাত ও কোমর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কোমড় আর হাত-পায়ের হাড়ের বেশ কয়েক জায়গায় ভেঙে যায়। অতিসত্ত্বর অপারেশন করা প্রয়োজন হয়। তাছাড়া রক্তক্ষরণ হয়েছে প্রচুর, কয়েক ব্যাগ রক্ত দেওয়া প্রয়োজন, নতুবা রক্তের অভাবে জনাব কামরুজ্জামানকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
তার রক্তের নমুনা নিয়ে পাঠানো হলো ল্যাবে, রক্তের গ্রুপ বের করে তৎক্ষণাৎ রক্ত দিতে হবে তাকে। ল্যাব থেকে জানানো হলো, O+ গ্রুপের রক্ত।
কামরুজ্জামান চাকরি করতেন অরিনোবা প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিতে, সেখান থেকে তার কলিগরা চলে এলেন সাহায্য করতে। ও+ গ্রুপধারী রক্তদাতার পাশাপাশি খোঁজা হতে লাগলো ব্লাড ব্যাংকেও। তার কলিগদের মাঝেই বেশ কয়জনের পাওয়া গেলো ও+ গ্রুপের রক্ত। তারা সকলেই রক্তদানের জন্য প্রস্তুত, চার-পাঁচ ব্যাগ রক্ত লাগবে। ডাক্তার সাহেব তাদের মধ্য থেকে সুস্থ-সামর্থ্যবান O+ve কয়েজনকে পাঠালেন ল্যাবে ক্রস ম্যাচিংয়ের জন্যে।
ল্যাবে গিয়ে দেখা গেলো, তাদের প্রত্যেকের রক্তই কামরুজ্জামানের রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে ফেলছে। আরে কী আশ্চর্য! প্রত্যেকেই নিজেদের রক্ত O+ve গ্রুপের বলেই তো জানতেন। ল্যাবে এবার একে একে সবার রক্ত পরীক্ষা করা হলো। পরীক্ষায় জানা গেলো, তারা ঠিকই O গ্রুপের রক্তবাহী, কিন্তু তবুও কামরুজ্জামানের রক্ত কিছুতেই মেলানো যাচ্ছে না। এবার উপায় খুঁজতে বসলেন ডাক্তাররা, কামরুজ্জামানের জীবন যায় যায় অবস্থা। বেশ কিছু ব্লাড ব্যাংক ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে রক্তের স্যাম্পল পাঠানো হলো, সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (পিজি হাসপাতাল) রক্তের স্যাম্পল গেলো। কেউ কোনো সমাধান দিতে পারলো না, তবে পিজি থেকে জবাব এলো। তারা জানিয়েছে, এই কামরুজ্জামানের রক্ত আর দশজন সাধারণ মানুষের রক্তের মতো নয়, খুবই দুর্লভ এক রক্ত এটি। আমাদের দেশে নেই বললেই চলে এ রক্তের বাহক। এই রক্তের গ্রুপ হলো ‘বোম্বে গ্রুপ’। ভারতে প্রতি দশ হাজারে একজনের মাঝে পাওয়া যায় এ রক্ত। বাংলাদেশ কিংবা ইউরোপ-আমেরিকাতেও ভারতের মতো সুলভ নয় বোম্বে গ্রুপের রক্ত। কামরুজ্জামানের যেহেতু বোম্বে রক্ত, পরিবারে অন্য কারো থাকাটাও অসম্ভব নয়। রক্ত পরীক্ষা করে জানা গেলো, কামরুজ্জামানের বোনের দেহে রয়েছে এই রক্ত। কিন্তু মেয়েটি রক্তদানের জন্য তখনো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে উঠেনি।
এবার শুরু হলো খোঁজ, দিকে দিকে কামরুজ্জামানের কলিগেরা ছুটে গেলো, ফোনে যোগাযোগ শুরু করলো দেশের প্রায় সকল ব্লাড ব্যাংক আর হাসপাতালে। কিন্তু কিছুতেই কিছু মিলছিলো না। ভারতে যেহেতু এই রক্ত আপেক্ষিকভাবে সুলভ, সেহেতু ভাবা হলো ভারত থেকে রক্ত আনার কথা, কিন্তু এও তো অনেক খরচান্তের ব্যাপার, কামরুজ্জামান একজন চাকরিজীবী মাত্র। অরিনোবা ইন্ডাস্ট্রির মালিক তখন জানালেন যে, তিনি ভারত থেকে কামরুজ্জামানের রক্ত আনার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা করতে রাজি আছেন। যাদের রক্ত বোম্বে গ্রুপের বলে নিশ্চিত হওয়া যায়, তাদের পরিচয় নথিভুক্ত করে রাখা হয়, নিয়মিত তাদের সকলের খোঁজ রাখা হয়। এমনই কাজ করা এক বেসরকারি সংস্থা হলো ‘থিংক ফাউন্ডেশন’।
অ্যাপোলো হাসপাতালের পরিচালক শেখ তুহিনুর আলম রোগী কামরুজ্জামানের রক্তের নমুনা নিয়ে ১৬ জুন মুম্বাইয়ে যান। থিংক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা বিনয় শেঠিই খোঁজ পেয়ে রক্ত খুঁজে দেন কামরুজ্জামানের জন্য। বিনয় শেঠি চারজন রক্তদাতার কাছ থেকে চার ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করে তুহিনুর আলমকে দেন।
মুম্বাইয়ের চার তরুণ স্বপ্না সাওয়ান্ত, কৃষ্ণানন্দ কোরি, মেহুল ভেলিকার ও প্রভীন সিন্ধে রক্তদান করেন কামরুজ্জামানের জন্য।
ভারতের আইন অনুযায়ী, সেখানকার কোনো নাগরিকের দেহাংশ দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু বিনয় শেঠির পৃষ্ঠপোষকতা ও দুই দেশের সরকারের বিশেষ বিবেচনায়, পরবর্তীতে আইনী জটিলতা এড়িয়ে কামরুজ্জামানের জন্য রক্ত আনার অনুমোদন দেয় ভারত সরকার। আন্তঃরাষ্ট্র সমঝোতায় রক্ত পেয়ে আবারো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে কামরুজ্জামান, আর ইতিহাসে স্থাপিত হয় মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
আমাদের দেশে বোম্বে রক্ত দুর্লভ হলেও, পুরোপুরি যে নেই তা নয়। ১৯৭৫ সালে সোনারগাঁওয়ে এক অভিজাত মিয়া পরিবারে সন্ধান মেলে এই রক্তের। ১৯৯০ সালেও নারায়ণগঞ্জে এই রক্তের এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছিলেন ডা. মজিবুর রহমান।
২০১০ সালে স্কয়ার হাসপাতালে এক ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর দেহেও পাওয়া যায় এই বোম্বে রক্ত।
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে ৩ বছরের ছোট্ট শিশু রনির জন্য এই রক্ত লাগলে নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। নেটিজেনরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল করতে সক্ষম হলে নরসিংদীতে মেহেদী আকাশ নামে একজনের সন্ধান মেলে ও তিনি ২৭ জানুয়ারি রক্তদান করেন।
একই বছর ২৫ নভেম্বর ২০২১ ঢাকায় বারডেম হাসপাতালে এক বৃদ্ধ বাবার বোম্বে রক্তের প্রয়োজন হয় এবং ভলান্টিয়ার নাঈম মজুমদারের মাধ্যমে যোগাযোগ হলে রাজীব নামে এক ভাই পরিচয় গোপন রেখে রক্তদান করেন।
এরপর বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে পিজি হাসপাতাল (BSMMU), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীকে রক্ত সঞ্চালন করতে গিয়ে এই বোম্বে রক্তের গ্রুপের রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়।
২০২৩ সালে ভুল করে ও পজিটিভ রক্ত ভেবে ডায়ালাইসিস করতে গিয়ে রক্ত সঞ্চালন করলে মিনু নামে এক মহিলার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। ফেইসবুকে সে খবর ছড়িয়ে পরলে দুইজন বোম্বে রক্তদাতা গোপনে রক্তদান করে চলে গিয়েছিলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত রোগীটি বাঁচেনি।
এছাড়াও, ৮ আগস্ট ২০২১ ফারিয়া
১৬ মার্চ ২০২২ সানজিদা আক্তার
১৫ আগস্ট ২০২২ ফেরদৌস আরা
২৫ আগস্ট ২০২২ ডালিয়া
১২ মার্চ ২০২৩ বিউটি ঘোষ প্রমুখ রোগীদের সন্ধান পাওয়া যায়।
উল্লেখ্য, সবাই বোম্বে পজিটিভ ছিলেন।
এই আর্টিকেল লেখা পর্যন্ত বাংলাদেশে এখনো বোম্বে নেগেটিভ রক্তের রোগী পাওয়া যায় নি।
তথ্য সংকলন ও লেখা:
মো. তাসনিমুল বারী
Bombay ব্লাড গ্রুপ কি?
বোম্বে রক্ত সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
নিকটাত্মীয়দের মাঝে রক্তদান না করাই কেন ভালো? গল্পে গল্পে সহজ পাঠ। ক্লিক
তথ্যসূত্রঃ রোর মিডিয়া, প্রথম আলো সহ অন্যান্য দেশি বিদেশি অনলাইন পোর্টাল, ফেইসবুক ও ব্যক্তিগত ভাবে সংগৃহীত তথ্য।
অন্যান্য পোস্ট সমূহ
মেহেদির ১০৬ ও রক্তবন্ধু
Author: রক্তবন্ধু | 13 Oct 2025
১০৬ বারের রক্তদানের ভেতরে রক্তবন্ধু থেকে প্রথম ফোনের মাধ্যমে প্লাটিলেট দান। ২০২০ এর দিকে রক্তবন্ধু ওয়েবসাইটে আমি রেজিস্ট্রেশন করি। https://roktobondhu.com আমার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। দীর্ঘ...
টহলরত সেনা সদস্যের রক্তদান
Author: রক্তবন্ধু | 21 Jun 2025
টহলরত সেনা সদস্যের রক্তদান দিনাজপুরে জরুরিভাবে রক্ত দিয়ে এক প্রসূতি মায়ের জীবন বাঁচিয়েছেন টহলরত এক সেনা সদস্য। শুক্রবার (২০ জুন) রাতে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ...
গভীর রাতের প্রশান্তি
Author: রক্তবন্ধু | 04 Feb 2025
রাত ৯টা ২৩। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল অপরিচিত এক নম্বর। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে খোরশেদ জাহান বললেন— "ভাই, আপনি তো...
Facebook Comments