গল্পে জানুনঃ রক্তরোগ গ্রাফট ভার্সাস হোস্ট ডিজিস
Author: রক্তবন্ধু | 27 May 2022

প্রসঙ্গঃ নিকট আত্মীয় এবং রক্তদান
Dr. Shahriar Parvez ভাইয়ের লেখাটি সামান্য সম্পাদন করে লিখা।
পরিচিত এক আংকেলের সার্জারী হলো। সার্জারীর সময় রক্তের প্রয়োজন হয়েছিলো। তার আপন ছোটভাই ছুটে এসেছিলেন রক্ত দিতে। অপারেশন সাকসেসফুলও হলো। ৬ দিন পর আংকেল রিলিজ নিয়ে খুশি খুশি বাড়ি চলে আসলেন! ১১তম দিনে উনার শরীরে কিছু র্যাশ দেখা দিলো। ধীরে ধীরে জ্বর এবং হালকা জন্ডিস এবং আস্তে আস্তে তার শরীর খুব খারাপের দিকে টার্ন নিলো!!
পুনঃরায় হাসপাতালে ভর্তি হলেন!
বড় বড় বেশ অনেকজন ডাক্তার তাকে দেখলেন এবং অনেক কষ্টে রোগ নির্ণীত হলো। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় শেষ পর্যন্ত তিনি মারাই গেলেন!!
রোগ টা কী ছিলো??
রোগটার নাম 𝐓𝐀-𝐆𝐕𝐇𝐃! এটা নিকটাত্মীয়ের ব্লাড Transfusion এর মাধ্যমে হয়। তাই একে Transfusion Associated Graft Versus Host Disease বলে।
নিকটাত্মীয়ের রক্ত নেবার পর এই রোগ হতে পারে। এই রোগটি হবার বেশ অনেক গুলো কারণ আছে। তবে এর মাঝে একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো নিকট আত্মীয় থেকে যদি কেউ রক্ত গ্রহন করে। যেমন এই আংকেলকে তার ছোটভাই রক্ত দিয়েছিলেন।
চমকে উঠলেন? ভাবলেন এ আবার কি বিপদ!!
আপনি তো কতবার নিজের পরিবারের সদস্যদের রক্ত দিয়েছেন! কই কিছুই তো হয় নি। সারাজীবন তো জেনে এসেছেন যে কাছের লোকেরা রক্ত দিলেই নিরাপদ! আপনি সামান্য ভুল জেনে এসেছেন।
আমরা আগে নিকটাত্মীয়ের রক্তের কথা বলতাম কারণ আগে সহজে রক্ত পাওয়া যেতো না। খুব কম মানুষ স্বেচ্ছায় রক্তদান করতো। নিকটাত্মীয়দের মাঝে সহজেই এবং দ্রুত একই রক্তের গ্রুপ খুঁজে পাবার সম্ভাবনা থাকে। ব্লাড ব্যাংকের পেশাদার, নেশাগ্রস্ত, মাদকাসক্ত বিভিন্ন রোগের অধিকারীর বিক্রি করা কারো রক্ত বিপদজনক। এছাড়াও আগে এই রোগটা সম্পর্কে তেমন জানা ও শোনা যায় নি। উন্নত গবেষণা থেকে এখন আমরা জানতে পেরেছি।

(বি.দ্র. শুধুমাত্র স্বেচ্ছায় রক্তদাতাগণ রেজিস্ট্রেশন করবেন।)
নিকট আত্মীয় বলতে কাদের বুঝায় এবং এক্ষেত্রে করণীয় কি সে সম্পর্কিত লেখার একটি লিংক শেষে দিয়ে দিবো।
আসলেই এমন ঘটনা হয় তবে খুব খুব রেয়ার!!
উপরে যে কেইস হিসট্রি বললাম ওটা আমার গত ৮ বছরের ডাক্তারি ক্যারিয়ারে দেখা একমাত্র কেস!
সুতরাং বুঝতেই পারছেন এটা কত রেয়ার!
কিন্তু রোগ টা খুব রেয়ার হলেও মৃত্যুহার ৯০-৯৫% ! অর্থাৎ এটি হলে মারা যাবার চান্স খুবই বেশী!
আচ্ছা এবার ব্যাখ্যা করি যে এটি কেন হয়।
শরীরের Immunity সিস্টেম (রোগব্যাধি প্রতিরোধ) সম্পর্কে যাদের একটু ভালো জ্ঞান আছে তারা ভালো বুঝবেন।
আমাদের সবার শরীরেই রক্তের মাঝে ইমিউন সিস্টেমের অংশ হিসেবে কিছু সৈন্য সামন্ত প্রহরী ঘুরে বেড়ায়!! এদের মাঝে বিখ্যাত একজনের নাম টি লিম্ফোসাইট (T Lymphocyte) বা টি সেল (T Cell)।
আচ্ছা, আজকে আদর করে ওকে টিলু ভাই ডাকা হোক। শিখাও হবে মজাও হবে!! বুঝতেও সুবিধা হবে।
তো টিলু ভাই করে কি যখনই শরীরে কোন অপরিচিত কেউ ঢুকে তখনি তাকে এট্যাক করে মেরে ফেলে!
যেমন ধরুন আজ ঠুস করে কোন ম্যাচিং ফ্যাচিং না করে আপনার কিডনী আমার শরীরে ফিট করে দিলাম! আমার রক্তের টিলু ভাই সাথে সাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করবে! ঐ অপরিচিত কিডনীকে সে মেরে ফেলবে! কিন্তু ম্যাচিং করে যদি কিডনী নিই তাহলে আমার নতুন কিডনি আর আমার টিলুভাই শান্তিপূর্নভাবে বসবাস করবে!
মাঝে মাঝে একে অপরকে জিজ্ঞাসা করবে “বাবু খাইসো?”
এবার বিষয়টা আরেকভাবে চিন্তা করুন।
ধরুন আপনার রক্ত আমার শরীরে নিলাম। আপনার রক্তে ভেসে বেড়ানো আপনার শরীরের টিলু ভাইয়েরা আমার শরীরে ঢুকে পড়লো।
ঢুকার সাথে সাথে আপনার টিলু ভাইয়ের মেজাজ হট হয়ে যাবে! কারণ সে দেখবে ডাইনে বায়ে উপর নিচে সব শত্রু আর শত্রু! যেহেতু সে আপনার শরীর থেকে আমার শরীরে এসেছে তার কাছে মনে হবে আমার কিডনী লিভার ফুসফুস বোনম্যারো.. সবাই তার শত্রু!!
তখন সে শুরু করবে আমার বিভিন্ন অঙ্গকে এট্যাক করা!
কিন্তু সে বেশিক্ষণ এট্যাক করতে পারবে না! কারণ আমার শরীরের ইমিউন সিস্টেম সহ আমার শরীরের টিলুভাই রা তাকে দেখে ফেলবে! দেখেই বুঝবে যে এরা ভিন্ন শরীর থেকে আসা টিলুভাই গ্যাং!! তখন আমার শরীরের Immunity সিস্টেম সাথে সাথে ওদের কে কান ধরে নিয়ে এসে থাপড়ায়া মেরে ফেলবে! ব্যাস সমস্যার সমাধান!!
এভাবেই আমরা রক্ত গ্রহণ করার পর ডোনারের রক্তের সাথে ভেসে আসা টিলুভাইয়ের আক্রমন থেকে বেঁচে যাই!!
কিন্তু-
এখন ধরুন আপনাকে রক্ত দিলো আপনার ভাই বা বোন! যেহেতু আপনারা ভাইবোন তাই কিছুটা সম্ভাবনা থাকে আপনার ভাই বা বোনের রক্তের টিলুভাই এবং আপনার রক্তের টিলুভাই অবিকল একই রকম দেখতে! ঠিক যেন কার্বন কপি!
সুতরাং আপনার ভাই বা বোন এর রক্তের টিলুভাই আপনার শরীরে ঢুকে যখন গ্যাঞ্জাম শুরু করবে তখন আপনার শরীরের ইমিউন সিস্টেম তাকে চিনতে পারবে না! কারণ দেখতে অবিকল নিজের ঘরের টিলু ভাইয়ের মতোই! এভাবে এরকম আপনজনের মুখোশ পরে আপনার ভাই/বোনের রক্তের টিলুভাইরা মনের সুখে তলে তলে আপনার শরীর ধ্বংস করতে থাকবে!! মানে ঘরের শত্রু বিভীষণ! আপনার টিলু ভাইয়েরা টেরই পাবে না।
এদিকে আপনার ইমিউন সিস্টেম বোকার মত চুপচাপ বসে থাকবে! শত্রুকে চিনতেই পারবে না!! এভাবে আস্তে আস্তে হয়তো আপনি মারা যাবেন! এই যে এই কন্ডিশনটা, এই বিশেষ রোগটার নামই TA GVHD..
আশা করি বুঝাতে পেরেছি।
বুঝেন আর না বুঝেন-TA GVHD সংক্রান্ত নীচের কয়েকটা পয়েন্ট শুধু মনে রাখুন।
১. জ্বী হ্যাঁ নিকট আত্মীয়ের রক্ত দিলে TA GVHD নামক ভয়ংকর একটি রোগ হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে৷ তবে খুব রেয়ার, সম্ভাবনা খুব রেয়ার!!
২. হ্যাঁ এটা সত্যি যে এ রোগের চিকিৎসা নেই!! ৯০-৯৫% লোকই মারা যায়৷ তবে আবার মনে করিয়ে দেই, এটি একটি রেয়ার রোগ!
৩. রেয়ার সম্ভাবনা হলেও যেহেতু এটা হওয়া সম্ভব, সেহেতু ডোনার হিসেবে অনাত্মীয় অর্থাৎ আত্মীয় নয় এমন কাউকেই প্রথম প্রায়োরিটি দিন। একান্তই না পাওয়া গেলে ভিন্ন কথা! রিস্ক নিতে হবে নিজেদের নিকটজনদের হতে রক্ত দিলে! (তাই রক্তদানে স্বার্থপর হতে নেই)
৪. আত্মীয়ের রক্ত যদি ইরেডিয়েট করে নিতে পারেন তাহলে এই রোগ হবার সম্ভাবনা নেই। তবে এই ইরেডিয়েট করার ব্যাপারটা বাংলাদেশে খুব খুব খুব কম হাসপাতালেই হয়!! (যেমন: স্কয়ার হাসপাতাল)
৫. রক্ত যেমন জীবন বাঁচায়, রক্তে তেমন জীবনও যায়! সুতরাং রক্ত ডোনেশন সম্পর্কিত সব তথ্য ভালোমত জেনে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব।
ধন্যবাদ সবাইকে!!
এই রোগ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে এবং প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানতে নিচের নীল রঙের লিংকে ক্লিক করে পড়ে নিন।
ট্রান্সফিউশন এসোসিয়েটেড গ্রাফট ভার্সাস হোস্ট ডিজিজ
অন্যান্য পোস্ট সমূহ

প্রসঙ্গঃ ডেঙ্গু ও প্লাটিলেট
Author: রক্তবন্ধু | 26 Jul 2023
দেশে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি এতে মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের সব রেকর্ড। বিশেষজ্ঞরা...

Polycythemia: রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যখন অস্বাভাবিক বেড়ে যায়
Author: রক্তবন্ধু | 02 Jul 2023
Polycythemia: রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা যখন অস্বাভাবিক বেড়ে যায় Poly অর্থ অনেক, বহু। রক্তে হিমোগ্লোবিন এর পরিমান স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেড়ে গেলে, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বহুগুণে...

প্রসঙ্গঃ ফ্রিজের রক্ত
Author: রক্তবন্ধু | 15 Apr 2023
রক্ত কখনোই ঘরোয়া ফ্রিজে বা অন্য রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা উচিত নয়। সুনির্দিষ্ট তাপমাত্রায় অনুমোদিত বিশেষ ব্যবস্থা সম্পন্ন ফ্রিজেই রক্ত সংরক্ষণ করা হয়। ৩০ মিনিটের...