গভীর রাতের প্রশান্তি

শেয়ার করুন:

রাত ৯টা ২৩। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল অপরিচিত এক নম্বর। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে খোরশেদ জাহান বললেন—

“ভাই, আপনি তো বলেছিলেন ১১টার পর হলে পারবেন। আজ কি পারবেন? রোগীর অবস্থা ভালো না…”

কথাগুলো শোনার পর আর চিন্তা করার সুযোগ রইল না। দুদিন আগেও এই রোগীর জন্য রক্তের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আর আজ যখন সত্যিই প্রয়োজন, তখন কি পিছিয়ে থাকা যায়?

দোকানের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরলাম রাত ১১টা ৩০-এ। শরীরের ক্লান্তি আর বিশ্রামের তাগিদ উপেক্ষা করে হাত-মুখ ধুয়ে, তড়িঘড়ি খাবার খেয়ে বের হলাম ১১টা ৪৫-এ। কিন্তু বের হয়েই বুঝলাম, রাত যত গভীর, পথ তত কঠিন। মূল সড়কে এসে দেখলাম, কোনো গাড়ি নেই। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর লোকাল এক সিএনজি পেলাম, সেটাতে উঠে নতুনপাড়া গেলাম। কিন্তু সেখান থেকেও সরাসরি হাসপাতালের কোনো বাহন নেই। বাধ্য হয়ে আরেকটি সিএনজি রিজার্ভ করলাম।

রাত ১২টা ১২। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোরে পা রাখলাম। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা, হাসপাতালের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য স্বজনের উৎকণ্ঠিত মুখ, আর এরই মাঝে আমি—একটি জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

রাত ২টা ০২। প্লাটিলেট সংগ্রহ শুরু হলো। ধীরে ধীরে আমার শরীর থেকে জীবনপ্রদায়ী কণিকা প্রবাহিত হচ্ছে কারও শিরায়, হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই কারও জীবনকে নতুন আলো দেবে। চোখ বন্ধ করলাম, মনে হলো—এটা আমার ৭ম প্লাটিলেট দান, আর মোট রক্তদান ২৮তম! ০৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।

রাত ২টা ৫৪। প্রক্রিয়া শেষ। শরীর কিছুটা দুর্বল, কিন্তু মনে প্রশান্তি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছিলেন রোগীর স্বজনেরা, কিন্তু আমি জানতাম—এটা আমার একার কাজ নয়। মানবতার এই পথে আমার ‘অপরাধের’ ভাগীদার ছিলেন Kazi Rahima Akter বোন, যিনি দয়া করে রোগীর খোঁজ দিয়ে আমাকে এই মহৎ কাজে যুক্ত করেছিলেন।

রাত ৩টা ৩০। হাসপাতালের করিডোর পেরিয়ে আবার সিএনজিতে উঠলাম। রাস্তাগুলো নীরব, বাতাসে এক অদ্ভুত শান্তি। ক্লান্তি ছিল, ঘুম ছিল না, কিন্তু মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছিল—

“আমরা যারা মানবতার এই ‘অপরাধী’, আমাদের শাস্তি কী?”

একটু ভেবে উত্তর পেলাম—

“সমাজ আমাদের অপরাধী ভাবতে পারে, কিন্তু এই অপরাধের শাস্তি হয়ত একটাই—একটা জীবন বাঁচানোর তৃপ্তি, এক বুক প্রশান্তি।”

এই ‘অপরাধী’ আমি ছিলাম, আছি, থাকব। যতদিন রক্তের এক ফোঁটা দিতে পারব, ততদিন!

এস এম সাব্বির আলম

এডমিন, রক্তবন্ধু চট্টগ্রাম। 


শেয়ার করুন:

Facebook Comments