রক্তের বন্ধন

শেয়ার করুন:

রক্তের বন্ধন

– সাইফুল ইসলাম

“এই কী করছেন আপনি? মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না?”
মুনতাহার কর্কশ কন্ঠে ঝাড়ি খেয়ে ছেলেটা হতভম্ভ হয়ে গেল। ছেলেটা কান থেকে মোবাইল নামিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। মুনতাহা তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বলল
“থাক আর এপোলাইজ করতে হবে না। বলবেন তো সরি, দেখিনি, জরুরি ছিল। এভাবেই রাস্তা ঘাটে মেয়েদের সাথে ধাক্কা খান…” মুনতাহা আরো কিছুক্ষণ বকাঝকা দিতেই পাশ থেকে একজন নার্স এসে মুনতাহাকে ঝাড়ি মারল
“হাসপাতালে কী শুরু করেছেন আপনি? ঝগড়া করলে বাইরে গিয়ে করুন।”

নার্সের কথা শুনে মুনতাহা বলল “এবারের মত আপনাকে ছেড়ে দিলাম। এটা হাসপাতাল না হলে…”
মুনতাহা গটগট করে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে ফোন কানে ধরল “বলোনা খালা, আজকালকার ছেলেরা যে ধান্ধাবাজ হয়েছে। চান্স পেলেই মেয়েদের গায়ে ধাক্কা খায়।”

খালা “থাক ওসব, আগে বল আপুর অবস্থা কী? শুনেছি আজকেও নাকি ব্লাড দিতে হবে?”

“ঠিকই শুনেছো খালা। কিন্তু ব্লাড কোথাও পাচ্ছি না।” মুনতাহার দীর্ঘশ্বাস খালা পর্যন্ত শুনতে পেল।

“এ পজেটিভ রক্ত তো রাস্তা ঘাটেই পাওয়া যায়…” খালাকে থামিয়ে দিয়ে মুনহাতা বলল “এই কারফিউর মধ্যে রক্ত পাই কোথায়? রাস্তা ঘাটে তো মানুষই নাই।” মুনতাহার কন্ঠে উৎকন্ঠা। “একটা ব্লাড গ্রুপের সাথে কাজ করছি গত ৩ বছর ধরে। সব ডোনার গত ৪ দিন ধরে কাউকে না কাউকে রক্ত দিয়েছে। বিভিন্ন মেডিকেলে ছাত্র আন্দোলনে আহতদের প্রচুর রক্ত লাগছে। সবাই সেখানে রক্ত দিয়েছে। শিমুল ভাইয়ার এবার মাকে রক্ত দেয়ার কথা ছিল। তিনি ১৫ তারিখে বাড়ি গেছেন। তিনিও ফিরতে পারছেন না। এদিকে মাকে আজ রক্ত দেয়া ফরজ। যদি কাউকে ম্যানেজ করতে না পারে তবে আমিই রক্ত দিব। আমার আর মায়ের রক্তের গ্রুপ তো সেইম।”

“আগে চেষ্টা করে দেখ কাউকে পাস কিনা। কাউকে না পেলে তুই রক্ত দিস। গত বছর তোর রক্ত নেয়ার পরে আপুর এলার্জির সমস্যা দেখা দিয়েছিল মনে আছে? সেজন্য ডাক্তার তোকে রক্ত দিতে নিষেধ করেছিলেনন।” ফোনের ওপাশ থেকে মুনতাহার খালা শায়লা গত বছরের কথা মনে করিয়ে দিলেন।

মুনতাহা খালার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল “এজন্যই আমাকে আমি লাস্ট অপশনে রেখেছি। যদি এ পজেটিভ ডোনার না পাই তাহলে আমি দিব। ভাইয়া একজন ডোনার কোন এক ফেইসবুক গ্রুপ থেকে জানি ম্যানেজ করেছিল। ছেলেটা এলো না। পরে শুনলাম পুলিশের স্বজনদের সে রক্ত দিবে না। অবশ্য ছেলের দোষ কী দিব? পুলিশ যেভাবে আবু সাঈদকে গুলি করে মেরেছে তাতে আমারও পুলিশের প্রতি ঘৃণা হয়। মানুষ সব পুলিশকে ঘৃণা করছে। কিন্তু আমার ভাইয়ার মত ভালো মানুষও তো পুলিশে কম না।” মুনতাহার ফোনে আরেকটা কল এলো। “ভাইয়া কল দিচ্ছে, খালা রাখি।”

“হ্যালো ভাইয়া”

“তোর ফোন বিজি কেন? দশ মিনিট ধরে কল দিয়ে যাচ্ছি।”

“এই হাসপাতালের নীচ তলায় মোবাইল নেটওয়ার্ক পায় না। তুমি যে ডোনারের কথা বলেছ তার ফোনের অপেক্ষায় বিল্ডিং এর বাইরে হাসপাতালের ক্যান্টিনে এসেছি। এর মধ্যে খালা কল দিল। খালার সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলাম।”

“ব্লাড ডোনার এসে তোর ফোনে পাচ্ছিল না। আমাকে কল দিয়েছিল। আমি কেবিনের ডিটেইলস জানিয়ে দিয়েছি। ছেলেটা কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে কল দিয়েছে। তুই জলদি যা। ছেলেটাকে নাকি যাত্রাবাড়ী যেতে হবে। ব্লাড দেয়া শেষ হতে হতে আমি হাসপাতালে চলে আসব। ছেলেটাকে যাত্রাবাড়ী পৌঁছে দিব।”

“বলো কী? যাত্রাবাড়ী থেকে কীভাবে এলো?”

“ওর আত্মীয়ের বাসা মোহাম্মদপুর। এখানে কী একটা কাজে এসেছিল। ওর মামা আমাদের থানার এসআই সুজনের বন্ধু। তার রেফারেন্সে ব্লাড দিতে এসেছে। তুই জলদি রুমের সামনে যা।”

roktobondhu || রক্তবন্ধু

মুনতাহা দ্রুত হেঁটে মায়ের কেবিনের দিকে যাচ্ছিল। পথে সেই নার্সের সাথে দেখা। মুনতাহার মনে হলো নার্সকে একটা সরি বলা দরকার। পানিতে নেমে কুমিরের সাথে ঝগড়া করা যায় না। নার্সরাই হাসপাতালের সব। এই ফ্লোরের ডিউটি নার্স উনি। নার্সকে “সরি, তখন আমার চিল্লাচিল্লি করা উচিৎ হয় নি।” বলতেই নার্স বলল “সরি আমাকে না বলে ঐ ছেলেটাকে বলেন। দোষ তো আপনার ই ছিল। ছেলেটা ঠিকভাবে আসছিল। আপনি অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁটছিলেন। ছেলেটা শেষ মুহুর্তে ঠোকাঠুকি ঠেকানোর চেষ্টাও করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি। আপনারই দোষ আর আপনি ঝাড়ি দিলেন তাকে। আসলে সুন্দরী মেয়েদের সমস্যাই এটা।” বলে নার্সও হাসি দিল।
মুনতাহা নার্সের কথা শুনে লজ্জিত হলো। শুধু শুধু একটা নিরাপরাধ ছেলেকে বকা দিল। নাহ, এখন এসব ভাবার সময় নেই। ব্লাড ডোনার চলে এসেছে। মুনতাহা হাসপাতালের কেবিনের কাছাকাছি যেতেই কেবিনের সামনের লোকটাকে দেখে চমকে গেল। একটু আগে এই ছেলের সাথেই তার ধাক্কা লেগেছিল। দোষ মুনতাহার আবার ঝাড়ি খেলো ছেলেটা। এই ছেলে কি মাকে রক্ত দিতে এসেছে? ছিহ: মুনতাহা ৫ মিনিট আগে ছেলেটার সাথে কী রকম দুর্ব্যবহার করেছে!

“আপনি মুনতাহা আপু?”

অন্য সময় হলে মুনতাহার মেজাজ গরম হয়ে যেত। বয়সে বেশি একটা ছেলে তাকে আপু ডাকছে। তার বয়স কি বেশি দেখাচ্ছে আজ? সবেমাত্র অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে।

“জ্বী ভাইয়া। আমি মুনতাহা।”

“আপনি ইন্সপেক্টর আজিজের..

“জ্বী ভাইয়া। আসলে আমি একটু আগের ঘটনার জন্য সরি..”

“আমার সময় কম আপু। আমাকে যাত্রাবাড়ী যেতে হবে। আপনি ক্রস ম্যাচিং এর ব্যবস্থা করুন।”

“আপনি আমার সাথে আসুন প্লিজ” বলে মুনতাহা নার্স স্টেশনের দিকে এগোলো।

 

(বি.দ্র: এটা জুলাই অভ্যুত্থানের গল্পের একটি পর্ব মাত্র। প্রথম পর্বটি রক্তদান সম্পর্কিত তাই এটুকুই ব্লগে দেয়া হলো।)


শেয়ার করুন:

Facebook Comments