প্রথম ভালোবাসা

শেয়ার করুন:

ছোটবেলায় শুনতাম, আমার আব্বু তার অফিসের বসের মেয়েকে (থ্যালাসেমিয়া রোগী) প্রায়ই ব্লাড ডোনেট করেন।

২০১১ সাল। তখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি।
তখন থেকে রক্তদান সম্পর্কে আমার জানা শুরু হয়।

ছোটকাল থেকেই প্রচন্ড ইচ্ছে ছিলো ১৮ বছর বয়স হলেই আমি ব্লাড ডোনেট করা শুরু করবো।
কিন্তু যখন বয়স ১৮ বছর হল জানতে পারলাম রক্তদানে শুধু বয়স নয়,
শারীরিক সুস্থতা, হিমোগ্লোবিন এর পাশাপাশি ওজনও পারফেক্ট হতে হবে।
ওজন হতে হবে কমপক্ষে ৪৮ কেজি।
আর ঐসময় আমার ৪ বছর ধরে ওজন ছিলো ৩৬ কেজি।
মন টাই ভেঙে গেলো…..

ওজন বৃদ্ধির মিশন শুরু করলাম ২০১৬ থেকে। ওজন বাড়াতে হবে ১২ কে.জি।
এতো সহজ কথা নয়, তাও আবার যে মেয়ে দুই বেলাই ঠিক মত খায় না।
তারপর থেকে চেষ্টা করলাম বেশি বেশি খাওয়ার। ২ বছর পরে মাত্র ৪ কেজি বেড়ে দাঁড়ালো ৪০ কেজিতে।

এরপর ২০১৯-এ ওজন ৪০-৪২ কেজিতে উঠা নামা করতো, ৩-৪ দিন পরপর ওজন মাপতে যেতাম।

আসলো ২০২০।
গুগল, ইউটিউব সহ যেখান থেকে যার কাছে যা শুনেছি ওজন বাড়ানোর টিপস নিতে থাকলাম।
সব খাওয়া শুরু করলাম যেগুলোতে ক্যালরি বেশী সেগুলো বেশি খাওয়া শুরু করলাম!
আর দিনে ৫, ৬ বার ভারি খাবার, নাস্তা তো আছেই।
শুধু খাচ্ছি আর খেয়েই যাচ্ছি! মানে রাক্ষসের মত খেয়েছি।
আমার গত ৫ বছর ধরে রাতে ঘুমানোর অভ্যাস ছিল না, যখন শুনলাম নিয়মিত ঘুমাতেও হবে, তখন রোজ রাতে যেভাবেই হোক ৬/৮ ঘন্টা ঘুমাতাম।

তারপর অবিশ্বাস্য ভাবে দেড় মাসে আমার ৬ কেজি ওজন বেড়ে যায়, ফাইনালি ৪৮ হয়।
জানিনা, ঠিক কিসের জন্যে আল্লাহর রহমতে ওজন বেড়েছিলো।

আর দুইদিনও দেরি না করে (ভয়ে ছিলাম যদি ওজন কমে যায়?) এক স্বেচ্ছাসেবী বন্ধু আবিরকে বললাম আমি ব্লাড ডোনেট করবো।
পরেরদিন সকালেই আমাকে রোগী খুঁজে দেয়া হলো।
আর তখন আসে আসল পরীক্ষা! আম্মুকে সাহস করে বলা, আর রাজি করানো।

দিনটি ছিলো ২৩/০৩/২০২০ইং
সকালে উঠে যখন আম্মুকে বলি, আম্মু এত জোরে “কি???” বলে উঠলো, আর ডিরেক্ট মুখের উপর না করে দিলো যে…। খবরদার এই কাজ করবি না। মেয়েরা ব্লাড দিলে ক্ষতি হয়, মেয়েদের ব্লাড দিতে হয়না ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর আম্মুকে কিছু আপুদের রক্তদানের ছবি দেখালাম, রক্তদানের উপকারিতা জানালাম, বললাম আম্মু দেখো এখন মেয়েরাও ছেলেদের থেকে রক্তদানে পিছিয়ে নেই। আর তোমার মেয়ের রক্তে একটা মানুষের জীবন বাঁচবে আম্মু।
আর আমাদের ইসলামেও আছে, রক্তদান হচ্ছে শ্রেষ্ঠ দান।
আম্মু রাজী হলেন।

অবশেষে আপুর সাথে পৌঁছালাম সায়েম হসপিটালে, রোগীর ছেলে নিচ থেকে নিয়ে গেলো।
আমি যখন রোগীর মায়ের কাছে যাই (ডায়ালাইসিস রোগী) উনি জিজ্ঞেস করলেন কে ব্লাড দিবে? আমি বললাম, আমি আন্টি।
তারপর আমাকে কাছে ডেকে, নাম, ঠিকানা, কোথায় থাকি জিজ্ঞেস করলেন।
আস্তে আস্তে আমার হাতটা ধরে উনি বলছিলেন “কোনো দাবি রেখো না মা, এভাবেই আমার সারাজীবন কাটবে, কতদিন বাঁচবো জানি না, আল্লাহ্ তোমাকে দীর্ঘজীবী করুক মা, অনেক দোয়া করি ভালো থাকো তুমি।” আমার আম্মুর মতো করে তিনি আমার গাল, মাথাতেও হাত রেখেছিলেন আর উনার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো। আমার অজান্তে আমার চোখ দিয়েও যে কখন পানি পড়ছিল বুঝিইনি। মনে হচ্ছিলো এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবথেকে মহৎ কাজটা আমি করতে যাচ্ছি।

এই যে মানুষগুলোর মুখের হাসি, ভালোবাসা, দোয়া গুলো না?

আমরা সত্যি লক্ষ কোটি টাকা দিয়েও কিনতে পারবো না।

আমি প্রথমবার ডোনেট করবো। সায়েম হসপিটালে আবার নতুন ডোনারের ব্লাড টানে না! তাই এখান থেকে আমাকে পাঠানো হলো ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে।

টেস্ট করতে যাবো, তখন শুরু হলো আমার ভয়!
ভয়? কিসের ভয়?
আরে? আমরা সুস্থ হয়েও শুধুমাত্র সুঁই এর ভয়ে যে ব্লাড ডোনেট করিনা। সেই ভয়।

আমার লাইফের মেডিকেল ব্লাড টেস্ট এর কাহিনী শুনলে বিশ্বাস করেন হাসতে হাসতে নিচে পরে যাবেন! সুঁই এর ভয়ে আমি যা যা করি, এমনকি বাড়িতেও কেউ আমাকে দিয়ে সুঁই ধরাতেই পারেনা। এতো ভয় পাই।

যখন আমাকে জানালা দিয়ে বললো হাত দেন, আমার ভয়ে হাত কাঁপছিলো, আর যখন সুঁইটা আমার ডান হাতের আঙুলে ফুটাতে গেছে, আমি ঠোঁট চেপে মনে মনে এতো জোরে চিৎকার করছিলাম যে কি বলবো! আমি তো ভয়ে রোগীর ছেলের হাতই ধরে ফেলেছিলাম!

কিন্তু….
কিন্তু…….. সাথে সাথে আমার মনে আসলো আরে?
ছেলেরা তো এতো ভয় পায় না? আর ছেলেরা পারলে আমি কেনো পারবো না?

আমি না নারী?
নারীদের তো জীবনে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়।
যখন আমরা “মা” হই, সেই সময়ের কষ্টগুলোর কাছে তো এই সামান্য সুঁই এর ঘা কিছুই না।
“আমরা নারী, আমরা সব পারি”
তারপর বীরের মত সাহস করে টেস্ট করার পর ব্লাড ট্রান্সফিউশন রুমে ঢুকলাম, অবশেষে এতোদিনের অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো।
যদিও আমার ভেইন খুঁজে পাচ্ছিল না, তাই বারবার সূঁচ ঢুকিয়ে চেষ্টা করতে হয়েছে।

অবশেষে আমার ব্লাড টানা শেষ হলো।
আর তখনের অনুভূতি, আত্মতৃপ্তিটা সত্যি বলে বুঝানোর মতো নয়।
এরপর থেকে কবে ৪ মাস হবে আমি অপেক্ষায় থাকি।

যারা এখনো ডোনেট করেননি, শুধু মাত্র একবার আমার মত ভয়কে জয় করে দেখুন।
একবার ডোনেট এর পরই আপনি চাইবেন ইশ! ৪ মাস শেষ হচ্ছে না কেন?
ভাববেন কেন রোজ ব্লাড ডোনেট করা যায়না!

তারপর রোগী আপনাকে না, আপনিই রোগী খুঁজবেন।

যারা আর্থিক অবস্থার জন্যে ইচ্ছে থাকা স্বত্তেও কাউকে সাহায্য করতে পারেন না, মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেন না, তাদের জন্যে স্বেচ্ছায় রক্তদান বেস্ট ওয়ে। আর এর মূল্য টাকা দিয়েও নির্ধারণ করা যায় না। এই দান কোন আর্থিক মূল্যের মানদণ্ডে নিরুপন করা যায় না।

“আপনার এক ব্যাগ রক্তদান, বাঁচাতে সহযোগিতা করবে মুমূর্ষ রোগীর প্রাণ”

যারা কষ্ট করে পড়েছেন তারা উৎসাহ দিলে ১৭ জুলাই ২০২০এর দ্বিতীয় রক্তদানের অভিজ্ঞতাও শেয়ার করতে চাই।

চাইলে আপনিও আপনার রক্তদানের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারেন।
আপনার অভিজ্ঞতা থেকে নতুন রক্তদাতারা উৎসাহ পেতে পারে।

পৃথিবীর সকল রক্তদাতাদের জানাই স্যালুট এবং অবিরাম ভালোবাসা।

নুসরাত জাহান মীম
স্বেচ্ছাসেবী ও রক্তদাতা,
অভিযাত্রিক ব্লাড ব্যাংক।
ব্লাড গ্রুপ: এবি+
ঢাকা।


শেয়ার করুন:

Facebook Comments