গভীর রাতে প্লাটিলেট দানের অনুভূতি

শেয়ার করুন:

গভীর রাতে প্লাটিলেট দানের অনুভূতি

প্রতিদিনের মতো আজকেও ফেসবুকে চেক করতেছি অনেক দিন হচ্ছে প্লাটিলেট দেওয়া হচ্ছিলো না।
যদি একটা রোগী পাই তাহলে প্লাটিলেট দিবো। প্রায় ৩ মাস হয়েছে প্লাটিলেট দেওয়া হয় না। নেগেটিভ রক্ত যেমন রেয়ার, তেমনই রোগী পাওয়া কষ্ট সাধ্য। অনেক সময় রোগী থাকলে টাইমিং মিলে না অথবা রেডি থাকলে রোগী পাই না।
রক্তবন্ধুর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঘোষণা দিয়েছিলাম তখনও রোগী পাই নাই।

হঠাৎ রাত আনুমানিক ১০ঃ৩০ মিনিটে মাহমুদুল হাসান ভাইয়ের একটা পোস্ট চোখে পড়লো। চারজন ও নেগেটিভ প্লাটিলেট ডোনার লাগবে ডেঙ্গু রোগীর জন্য। রোগীর প্লাটিলেট কাউন্ট মাত্র ৮ হাজার।

আসলে চারজন প্লাটিলেট ডোনার লাগবে না, চারজন থেকে হোল ব্লাড অর্থাৎ রেড সেলটা নিয়ে একটা প্লাটিলেট করবে।
উনাদের বুঝার ভুল ছিল বা ডাক্তার বিস্তারিত খুলে বলেন নাই। যাই হোক হাসান ভাইকে নক দিলাম ডাক্তার এর রিকুইজিশন পেপার টা দিন।

ততোক্ষণে রোগীর লোক ইনবক্সে নক দিয়ে রিকুইজিশন পেপার এর ছবি দিয়েছেন।

আমি যা মনে করেছিলাম তাই। চারজন ডোনার থেকে একটা প্লাটিলেট করবে। উনাকে বলাম ভাই একজন থেকে এফেরেসিস মেশিনে প্লাটিলেট করা যায় এতে রোগীর জন্য উপকার হয় এবং ৪ টা ডোনার খুঁজতে হয়রান হতে হয় না।

উনিও বললেন জ্বী করা যায় ভাই, আমি নিজেও দিয়েছি ২ বার। কিন্তু রোগীর ফিনান্সিয়াল অবস্থা তেমন ভালো না ততক্ষণে ৩টা ডোনার ম্যানেজ হয়ে গেছে উনাদের।

আমি বলি তাহলে তো আর সমস্যা নেই, যেহেতু ৩ টা ডোনার ম্যানেজ হয়েছে। যেখানে একটা ডোনার পাওয়া কষ্ট সাধ্য সেখানে ৩ টা পেয়েছেন, এদিকে রোগীর অবস্থা যেহেতু খারাপ তাহলে ৪ জন থেকেই করুন।

এরপর ১২ঃ২০ দিকে আমি ঘুমিয়ে পরি। রাত ১ঃ১৭ মিনিটের দিকে একটা ফোন আসে। আমি ততোক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিছুক্ষণ আগে ঘুমালাম। কাঁচা ঘুমের ঘোরে আচমকা ভয়ও পেলাম!
– ভাই আপনার সাথে কথা হয়েছিল ইনবক্সে প্লাটিলেট নিয়ে। (আমি উনাকে ফোন নাম্বারও দেই নি। উনি ইনবক্সে নক দিয়ে আমাকে না পেয়ে পরে আমার আইডিতে হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার পেয়ে যোগাযোগ করেছিলেন।)
বললেন ভাই রোগীর অবস্থা খারাপ। উনাদের দুইজন ডোনার মিসিং হয়েছে। একজনের হোলব্লাড টানাও হয়েছে। একজনের থেকে প্লাটিলেট আলাদা করে তো তেমন কোন ফল পাওয়া যাবে না!
এখন একজন থেকে এফেরেসিস মেশিনে প্লাটিলেট নিবে, আপনি দিতে পারবেন? জিজ্ঞেস করি আপনি শিওর একজন থেকে নিবে?

উনি জানালেন, হ্যাঁ শিওর ভাই। উনাদেরকে আপনার ঠিকানা দিই, আপনাকে নিয়ে আসবে। আমি ঠিকানা দিতেই যেন সময় লেগেছে, উনারা আমার বাসার সামনে রিক্সা নিয়ে হাজির। আসলে যে বিপদে পরে সেই বুঝতে পারে কতটা কষ্ট করতে হয়।

অবশেষে ১০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে হাজির হলাম। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠার কারণে শরীর উইক লাগছে। হসপিটাল গিয়ে ডাবের পানি খেলাম। এরপর CBC টেস্ট করার জন্য পাশের আরেকটা ক্লিনিক গেলাম। ওখানের রিসিপসনের দিদি রোগীর আত্মীয়। দিদি নিজে এতো রাতে গিয়ে হসপিটালের গেইট খুলিয়ে আমার CBC করিয়ে দিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ রিপোর্টে সব কিছু মোটামুটি ভালো আসছে।

একটা কাক যেমন বিপদে পড়লে অন্য কাক গুলো ছুটে আসে, তেমনই উনাদের আত্মীয়স্বজন সবাই মনে হয় হসপিটালে ছুটে আসছে!

আমি যাওয়ার সাথে সাথে পারলে আমাকে মাথায় তুলে রাখে।
উনারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী, আমি মুসলিম ধর্মের। উনারা একবারের জন্যও মনে করেন নাই আমি অন্য ধর্মের। আমাকে নিজের ভাইয়ের মতো করে আগে পানি খাওয়ালো। কি খাবো সবাই রীতিমত অস্থির হয়ে গেছে।
আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় আমরা মানুষ। ধর্ম পালন ভিন্ন জিনিস। মানবতার কোন ধর্ম হয় না। ধর্ম মানবতার শিক্ষাই দেয়। মানুষের বিপদে এগিয়ে আসার শিক্ষা সকল ধর্মের।

উনাদের পরিবারের মনে হয় কেউ বাকি ছিলো না, সবাই হসপিটালে চলে আসছে রোগীর টেনশনে! কারও চোখে ঘুম নেই।

রাত তখন ২ঃ৩০ ছুঁই ছুঁই।

এদিকে হসপিটালের সিস্টেম সকাল ৮ টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত প্লাটিলেট টানে। এরপর প্লাটিলেট টানানো হয় না। অথচ উনাদের জন্য টেকনিশিয়ান পর্যন্ত অনেক রাত অবধি অপেক্ষা করেছেন। রাত ৩ টা বাজে প্লাটিলেট টানলো।

রোগীর লোকের আন্তরিকতা যথেষ্ট ভালো ছিল। আসলে টাকা-পয়সা আর ধন-দৌলত হলেই হয় না, সুন্দর একটা মন লাগে যা উনাদের মধ্যে অতুলনীয়। ভালো লেগেছে রোগীর জন্য সবাই হসপিটালে ছুটে এসে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে।
এখনকার সময় কে কার খবর রাখে!

মানুষের আন্তরিকতা আর ভালোবাসায় বার বার ফিরে যাই রক্তদানে।

উনাদের আন্তরিকতা আর কৃতজ্ঞতা বলে শেষ করা যাবে না। সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে আমরা যেন অসহায় মানুষের সেবায় থাকতে পারি সব সময়।

আলহামদুলিল্লাহ! অনেকদিন অপেক্ষার পর প্লাটিলেট দিতে পেরেছি।
মনে অনেক শান্তি লাগছে।

কৃতজ্ঞতা হাসান ভাই আপনার প্রতি। হসপিটাল যাওয়া থেকে আসা পর্যন্ত যোগাযোগ রেখেছেন। রোগীর লোকের হেল্পও ভোলার মতো না। এতো কিছুর প্রয়োজন ছিল না। যথেষ্ট হেল্পফুল আপনি এবং রোগীর মানুষ।

ফরহাদ চৌধুরী রিয়াদ (নোয়াখালী)
ও নেগেটিভ প্লাটিলেট ডোনার, ঢাকা।
৩০/০৮/২০২২ ইং
🟡 প্লাটিলেট ৮ বার।
🔴 হোল ব্লাড ১১ বার, সব মিলিয়ে ১৯ বার।


শেয়ার করুন:

Facebook Comments