আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি

শেয়ার করুন:

আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি…

১ম রক্তদান করতে চেয়েছিলাম জন্মদিন উপলক্ষে, কিন্তু রোগীর প্রয়োজনে জন্মদিনের ১১দিন আগেই দিতে হয়েছিল। তারপর ২য়, তারপর ৩য়। ৩য় রক্তদানের ৯দিন পর হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরি হয়ে গেল। আমি তো ভেবেই নিছিলাম, আর মনে হয় রক্তদান করতে পারবো না। কিন্তু না, ডাক্তারের পরামর্শে আবার রক্তদান শুরু হয়ে গেল। ৪র্থ রক্তদান সম্পন্ন করলাম জন্মদিনের ১৯দিন আগে, কিন্তু তখনো পা পুরোপুরি সুস্থ না। ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ রক্তদান সম্পন্ন করলাম, আবার কিছুদিন পর হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরি। সুস্থ হয়ে ৭ম, ৮ম, ৯ম রক্তদান সম্পন্ন করলাম।
এরপর গাজীপুর আসলাম। সময়-সুযোগ এসেছে প্লাটিলেট দেয়ার। প্লাটিলেট দেয়ার ইচ্ছা অনেকদিনের। কিন্তু আমি যেসব জায়গায় অবস্থান করতাম, সেসব জায়গায় এফেরেসিস মেশিন না থাকার কারণে প্লাটিলেট দানের ইচ্ছা পূরণ হয়নি। গাজীপুর থেকে ঢাকার ট্রেন যোগাযোগ খুব ভালো হওয়ার ফলে প্লাটিলেট দেয়ার ইচ্ছা আরো বেড়ে গেল। শুরু হলো রোগী খোঁজা, কিন্তু প্লাটিলেট গ্রহীতা রোগী তো সহজে পাওয়া যায় না। রোগীর প্রয়োজনে ঢাকাতে আবারো ২বার (১০ম এবং ১১তম) হোল ব্লাড দিয়ে দিলাম।

হোল ব্লাড দেয়ার ৪মাস পূর্ণ হওয়ার পর আবার শুরু হলো রোগী খোঁজা। অবশেষে আগস্টের ২তারিখ ইরফান ভাই জানালেন, “রোগী পাওয়া গেছে। আগামীকাল পুলিশ হাসপাতালে দিতে হবে। রোগী ও রোগীর মেয়ে রাতের বাসে লক্ষ্মীপুর থেকে আসতেছে, দিনের বেলা প্লাটিলেট নিয়ে আবার চলে যাবে।” ইরফান ভাইয়ের কথা শোনার পর ১ম রক্তদানের আগে যেমন ফিলিংস হয়েছিল, সেদিন তার থেকেও বেশি ভালোলাগা কাজ করছিল। একটু পর মনে একটা ভয় কাজ করছিল, যদি প্লাটিলেট ডোনার হিসেবে রিজেক্ট হয়ে যাই? রাতে রোগীর লোকের সাথে কথা হলো।

পরেরদিন সকালে ট্রেনে কমলাপুর পৌছানোর পর রোগীর মেয়ে ফোন দিয়ে জানালো, পুলিশ হাসপাতালে তারা সিট পায়নি, সিট পেতে হলে বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু উনারা রাতেই বাড়ি ফিরতে চায়। আমি ইরফান ভাইকে বিস্তারিত জানালাম, ইরফান ভাই থ্যালাসেমিয়া হাসপাতালে সবকিছু ব্যবস্থা করে দিলেন।

অবশেষে জীবনের প্রথম প্লাটিলেট দান করলাম ৩ আগস্ট ২০২২। পাশে ছিল বন্ধু রক্তবন্ধু জয়নাল। ১ম বার প্লাটিলেট কাউন্ট ছিল ২লক্ষ ৮০হাজার।

জয়নাল সত্যিই আমার রক্তবন্ধু! আমাদের দু’জনেরই বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলায়, দুজনেরই রক্তের গ্রুপ এবি+, আমরা দু’জনেই রক্তবন্ধুর ভলান্টিয়ার, এবং সে আমার বন্ধু! আমরা হবিগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র, সে ইলেক্ট্রিকাল ডিপার্টমেন্টে আর আমি সিভিল ইঞ্জিয়ারিংয়ে।  তারও পায়ে সমস্যা আছে, এক্সিডেন্ট করেছিলো, অপারেশন করতে হয়েছিলো। দীর্ঘদিন  রক্তদান করতে পারে নাই। ডাক্তারের পরামর্শে এখন আবার রক্তদান শুরু করেছে।

২য় বার জন্মদিনে দিতে চাইলাম (২২ আগস্ট আমার জন্মদিন ছিল), কিন্তু রোগী পাওয়া যাচ্ছে না।
২৯ আগস্ট আকরাম ভাই জানালো জিমের জন্য হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে প্লাটিলেট লাগবে। রাতে জিমের মায়ের সাথে কথা হলো। (জিম হলো ক্যান্সারে আক্রান্ত একটা ছোট্ট মেয়ে, স্বেচ্ছাসেবী কাজে জড়িত থাকার সুবাদে ছবি দেখেছিলাম অনেক আগেই। তাদের বাড়ি টাঙ্গাইলে)
পরের দিন সকালের ট্রেনে প্রথমে কমলাপুর, তারপর বাসে করে হৃদরোগ ইন্সটিটিউট। ১ম প্লাটিলেট দানের ২৬দিন পর ২য় বার প্লাটিলেট দিলাম ৩০ আগস্ট ২০২২। প্লাটিলেট কাউন্ট ৩লক্ষ ৩৯হাজার। জন্মদিনে দিতে পারিনি, কিন্তু জন্মামাসে ২বার দিতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ।

জিম আছে শিশু হাসপাতাল, চলে গেলাম দেখতে।
ছোট্ট একটা মিষ্টি মেয়ে। এতোদিন ছবিতে দেখেছি, আজ সরাসরি প্রথম দেখলাম। প্রথম দেখাতেই আমার চোখে জল এসে গেছে। জিমকে বললাম, কেমন আছো মা? উত্তরে বলেছিল, ❝আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছো?❞

আমি তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। জহিরুল ভাইকে (জিমের বাবা) বললাম, “ভাই আমি যাই” বলেই সনি আপুকে (জিমের মা) সালাম দিয়ে চলে আসছি।
যেখানে আর ১সেকেন্ড থাকলেই আমি কান্না করে দিতাম, সেখানে কোন সাহসে জিমের প্রশ্নের উত্তর দিবো?
এতটুকু ছোট্ট একটা বাচ্চার নাকি ক্যান্সার 😢

হে আল্লাহ, সুস্থ করে দাও জিমকে 🤲

মো. শহীদুল্লাহ, এবি পজিটিভ
সহযোগী এডমিন, রক্তবন্ধু।
সাবেক জেলা প্রতিনিধি, রক্তবন্ধু ঠাকুরগাঁও। 


শেয়ার করুন:

Facebook Comments