আলোর গল্প
Author: রক্তবন্ধু | 29 May 2022
পরিবারের চাপে বিয়েটা করেই ফেললাম। সবাই বলছিলো বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে। বউ মাশা’আল্লাহ। না হয়ে যাবে কই? ৪ বছরের প্রেমের সফলতা যে! ভালোই দিন কেটে যাচ্ছিলো। বিয়ের পর থেকেই দাদী প্রায়শই বলতো, “বাঁইচা থাকতে নাতি পুতির মুখ দেইখা যাইতে পারমু না মনেহয়”। এইখানেও চাপ প্রয়োগ, ইমোশনাল ব্লাকমেইল, কি আর করা! অবশেষে বিয়ের ৩ বছরের মাথায় একটা কন্যা সন্তান এলো ঘর আলো করে। দাদী খুশি, ঘরের সবাই খুশি, আত্মীয়-স্বজন সবাই বেশ খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি ছিলাম আমি তারপরেই আমার বউ। এই দিনগুলোর কথা কখনো ভোলার নয়। সবার এই খুশির নাম রাখা হল “আলো”।
জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিনগুলো কাটাচ্ছিলাম আমি তখন। আলোর মুখ না দেখলে ভালোই লাগতোনা। কাজের মধ্যে সময় পেলেই দৌঁড়ে চলে আসতাম তাকে দেখতে। এভাবেই দেখতে দেখতে আলোর বয়স তখন ৩ মাস ১২ দিন, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো আমার আলো! কেমন ঠিক করে হাসে না, খায় না আর শুকিয়ে যাচ্ছিলো প্রতিদিন.. চলে গেলাম ডাক্তার দেখাতে। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে ডাক্তার যা বললেন তা শোনার শক্তি শুধু আমার কেনো পৃথিবীর কোনো বাবারই হয়তো নেই। মনে হচ্ছিলো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে আর আমি তলিয়ে যাচ্ছি এক অতল গহ্বরে। ডাক্তার সাহেবের কথাগুলি এখনো কানে বাজে, “আপনার মেয়ের থ্যালাসেমিয়া রোগ আছে!” আমি কিছুই বুঝলাম না এটা কি বলে ডাক্তার এটা আবার কেমন রোগ!
তখন তিনি বললেন, এই রোগ নাকি আমার আর আমার স্ত্রীর কারণে হয়েছে, আমরা নাকি এই রোগের বাহক। এই রোগ হলে শরীরের রক্তে হিমোগ্লোবিন উৎপন্ন হয় না। সারাজীবন অন্য মানুষের রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। আমার মেয়ের আবার নাকি ও নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত যা হাজারেও একজন মানুষের হয় না। যাকে না দেখে এক মুহুর্ত থাকতে পারিনা আমি, আমার সেই আলো নাকি রক্তের অভাবে মারা যাবে! কিছুতেই মানতে পারছিলাম না তখন। এরপর থেকে আমার আলোর জীবন প্রদীপ জ্বেলে রাখতে রক্তের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, হাত-পা ধরে কান্নাকাটি করেছি মেয়েটার মুখটা আরো কয়েকটা দিন বেশি দেখার জন্য।
এভাবে কেটে গেছে আরো ১০ টি বছর। আনন্দ কাকে বলে ভুলে গেছি আমি। আলো বেঁচে আছে তবু প্রতি মূহুর্তে হারাবার ভয়ে সিটকে থাকি। অন্ধকারময় জীবনের মাঝে আছি এখন। প্রতি মাসে ২ ব্যাগ, মাঝে মাঝে ১ ব্যাগ রক্ত লাগে ওর।
ও নেগেটিভ এর মত দুর্লভ রক্ত। তাও প্রতি মাসে ২ ব্যাগ। অসম্ভব নয়, কিন্তু সম্ভব করা যে কতটা কঠিন সেটা আমার মত হতভাগা বাবা যারা তারাই জানেন। শুধুই আফসোস হচ্ছিলো কেন বিয়ের আগে রক্তে ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা করলাম না।
এইতো বেশি না দিন পনেরো মতন হবে একজন মানুষের মত দেখতে একটা অমানুষ, রক্তদাতা পরিচয় দিয়ে আসবো বলে টাকা নিয়ে আর আসলো না। এমন অবস্থায় রক্ত পাচ্ছিলাম না কোথাও। মেয়েটা আমার হাত শক্ত করে ধরে বলছিলো ❝বাবা তুমি চিন্তা করোনা আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। তুমি আমার পাশেই থাকো সবসময়।❞
কিন্তু, দুইটা দিন কথা রাখলো না মেয়েটা, হঠাৎ কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার হৃদয়ের আলোটা দপ করে নিভে গেল আমার চোখের সামনেই।
ওর রেখে যাওয়া শেষ প্রশ্ন ছিলো “বাবা আমার এত রক্ত লাগে কেন?”
“কেন” এর উত্তর আর দেয়া হলনা..
হৃদয় ভেঙ্গে শুধু একটা কথাই বের হয়ে আসতে চেয়েছিলো,
তুই পাশেই আছিস মা, বুকের বা পাশে………থাকবি সারাজীবন।
থ্যালাসামিয়া রুখতে বিয়ের পূর্বে উভয়েই রক্ত পরীক্ষা করে নিন।
হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস টেস্ট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পড়ুন Electrophoresis
অন্যান্য পোস্ট সমূহ
মেহেদির ১০৬ ও রক্তবন্ধু
Author: রক্তবন্ধু | 13 Oct 2025
১০৬ বারের রক্তদানের ভেতরে রক্তবন্ধু থেকে প্রথম ফোনের মাধ্যমে প্লাটিলেট দান। ২০২০ এর দিকে রক্তবন্ধু ওয়েবসাইটে আমি রেজিস্ট্রেশন করি। https://roktobondhu.com আমার বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। দীর্ঘ...
টহলরত সেনা সদস্যের রক্তদান
Author: রক্তবন্ধু | 21 Jun 2025
টহলরত সেনা সদস্যের রক্তদান দিনাজপুরে জরুরিভাবে রক্ত দিয়ে এক প্রসূতি মায়ের জীবন বাঁচিয়েছেন টহলরত এক সেনা সদস্য। শুক্রবার (২০ জুন) রাতে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ...
গভীর রাতের প্রশান্তি
Author: রক্তবন্ধু | 04 Feb 2025
রাত ৯টা ২৩। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল অপরিচিত এক নম্বর। কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে খোরশেদ জাহান বললেন— "ভাই, আপনি তো...
Facebook Comments