বিপ্লব, দ্যা সুপার হিরো

শেয়ার করুন:

আমার কলিগ এর জন্য রক্ত লাগবে।
গাজীপুরের এক ভলান্টিয়ার ভাই ডোনারের নাম্বার দিলেন। আমি ওনাকে কল দিলাম
-ভাইয়া, আমার এক্সিডেন্ট রোগীর জন্য এমার্জেন্সি এ+ ব্লাড লাগবে, দিতে পারবেন?

বলার সাথে সাথে বললেন, ভাই কোথায় কখন লাগবে? আমি দিতে ইচ্ছুক।

ঠিকানা দিলাম। বললাম আমাদের রোগী পঙ্গু হাসপাতালে, এমার্জেন্সিতে আছেন। ব্লাডের জন্য অপারেশন থিয়েটারে নিচ্ছে না। ব্লাড পেলে অপারেশনে নিয়ে যাবো। রক্তদাতা ভাইয়াটা কোনও রকম অজুহাত না দেখিয়ে সাথে সাথে রাজি হলেন আর বললেন ❝আমি আসতেছি।❞

উনি মুগদায় ছিলেন, সেখান থেকে রওনা দিলেন।

কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের রোগীর অবস্থা তেমন ভালোর দিকে না থাকার কারণে মোহাম্মদপুরে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যেতে হচ্ছে। তখন আবার ভাইয়াটাকে কল দিয়ে বললাম,
ভাইয়া কই আছেন, জানালেন বিজয় স্মরণী আছেন। তাকে বললাম আমাদের রোগীকে পঙ্গু হাসপাতাল থেকে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এর কাছে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আপনি ওখানে চলে আসুন প্লিজ। বিশ্বাস করেন, উনি কোনও রকম অজুহাত বা কোনও রকম পেরেশানি বা বিরক্তি দেখিয়ে আমাকে কথা বলেননি। শুধু বলেছেন ❝ওকে ভাই, আমি ওখানে চলে আসতেছি❞

আমরা হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই উনি সেখানে হাজির! ওনাকে কল দিবো দূরে থাক, উল্টো উনিই আগে পৌঁছে আমাকে কল দিয়ে বলতেছেন, “ভাই আমি হাসপাতালের গেটে!” উনি যাওয়ার ঠিক ১০ মিনিট পর আমরাও রোগী নিয়ে হাসপাতালের গেটে পৌঁছে যাই। ভাইয়ার সাথে প্রথম দেখা হলো।

তবে জানতাম না তিনি যে শুধু একজন রক্তদাতাই নন, একজন সুপার হিরো। কেন সুপারহিরো সে কথা পরে বলছি।

আমাদের রোগীকে আবার এমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়া হলো। হাসপাতালের চিকিৎসকগণ একে একে সব আসলেন দেখলেন। এতে আমাদের অপারেশন থিয়েটারে রোগী নিয়ে যেতে প্রায় রাত ১টা বেজে যায়!
তখনও এই সুপার হিরো আমাদের সাথে বসে আছেন, গল্প করছেন। কোনও রকম বিরক্তি বোধ করছেন না বা রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে যাবেন কীভাবে যেন সেই ভাবনাও নেই।
মাঝখানে ফ্রি সময়ে একসাথে নাস্তা করলাম। ভাত খেতে বললাম এতো করে খেলেন না।
যাই হোক এবার এলো রক্ত দেওয়ার পালা। রাত তখন প্রায় ২টা। ডাক্তার ব্লাড চেয়ে বসলেন। রোগীকে ওটিতে নিয়ে গেছে ব্লাড লাগবে। তখন সুপারহিরো কে নিয়ে রওনা দিলাম হাসপাতালের ৫ম তলায় ব্লাড ট্রান্সফিউশন রুমের দিকে।
ট্রান্সফিউশন রুমে গিয়ে ব্লাড এর স্যাম্পল জমা দেয়া হলো।
স্যালাইন পানি, এক প্যাকেট কেক খাইয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। কখন ক্রস ম্যাচিং রিপোর্ট দিবে, রিপোর্ট ওকে হলে ব্লাড টানবে! আধ ঘন্টা পর রিপোর্ট আসলো। রিপোর্ট ও.কে, ডোনার থেকে এখন ব্লাড টানবে। তখন রাত ঠিক ২:১৯! ডোনার কে আবার ব্লাড ট্রান্সফিউশন রুমে ঢুকালো, ব্লাড টানলো।

রক্ত টানার পর প্রিয় সুপার হিরোর সাথে আলাপ আলোচনা করতে থাকি। আলাপ করতে করতে বের হয়ে আসলো সেই সুপারহিরোর গল্প।
তিনি একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। জিজ্ঞেস করলাম ছোট ব্যবসায়ী বলতে কিসের ব্যবসা? জানতে চাইলাম।

বললেন, ❝ভাইয়া আমি ডালায় করে পান, সিগারেট বিক্রি করি, মুগদায়❞
কথাটা শুনে অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছু সময়। পরে আরোও অনেক আলাপ আলোচনাও হয়েছে।
ভাইয়াটার মা বেঁচে নেই। বোন আছে একটা, ছোট্ট ভাগনিও আছে একটা। বেশী আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। এরপর ব্লাড নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে জমা দিলাম।

সম্প্রতি একটা রেডিমেড দোকান কিনে নিয়েছেন। রাস্তায় দোকান করে চলেন।

বিদায় দেওয়ার পালা। রাত অনেক গভীর। প্রায় ভোর হয়েই তো যাচ্ছে! বিদায় দেওয়ার সময় ওনাকে ১হাজার টাকা হাতে দিলাম, নিলো না। অনেক জোর জবরদস্তি করলে তিনি বললেন, ভাই, তাহলে শুধু ভাড়াটাই দেন।
তাকে পাঠাওয়ে তুলে দিলাম। ঘন্টা খানেক পরে খোঁজ নিলাম বাসায় পৌঁছালো কি না, শরীর কেমন আছে।

সব কিছু ঠিকঠাক।

এই রক্তদাতা সুপার হিরোর নাম
মোঃ বিপ্লব হোসেন।
সত্যিই, একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেলেন।

এটা ছিলো তার ২য় রক্তদান।

(তার ব্যবসা সহ ছবি চেয়েছিলাম পাঠক ও হবু রক্তদাতাদের উৎসাহিত করতে। উনি সংকোচ, বিব্রত ও লজ্জাবোধ করছিলেন। তাই রক্তদানের ছবিতেও ব্লার করা হলো। পরে শুধু দোকানের ছবি দিয়েছেন।)

আসলে রক্তদান নির্ভর করে মন মনন আর ইচ্ছে শক্তির উপর। পেশা, শিক্ষাগত যোগ্যতায় নয়।
অনেক শিক্ষিত মানুষজন আছে, তারা তো সচেতন।
অনেক উচ্চ পদস্থ লোক আছেন। তারা তো উচ্চ শিক্ষিত সচেতন মানুষ।
তার মানে এরা শিক্ষা জীবনেও ভালো ছাত্র ছিলেন। তাদের অনেককেই, সিংহভাগকেই রক্তদানে পাওয়া যায় না।

খেয়াল করে দেখবেন এইসব রক্তদানের কাজে কাদের বেশি দেখা যায়।
বলছি না যে তারা মানবিক কাজ করেন না বা রক্তদান করেন না।
শুধু খেয়াল করতে বলেছি যে, স্বেচ্ছাসেবী কাজে, ভলান্টারি জগতে, রক্তদানের ময়দানে কোন মানুষদের, কেমন ছাত্রদের দৌঁড় ঝাঁপ বেশি…

নয়ন রাজ, মীরসরাই, চট্টগ্রাম।

স্বেচ্ছাসেবী,
রক্তবন্ধু গাজীপুর (চাকুরিসূত্রে)।

এডমিন, সীতাকুণ্ড ব্লাড ডোনার্স সোসাইটি।

শুধুমাত্র স্বেচ্ছায় রক্তদাতাগণ রেজিস্ট্রেশন করবেন।


শেয়ার করুন:

Facebook Comments