রাজরক্ত

শেয়ার করুন:

রাজরক্ত

কেন রাজরক্ত বললাম সে ঘটনা শেষে জানবেন।
সপ্তাহ খানেক আগে বোদা উপজেলা (পঞ্চগড়) থেকে এক বড় ভাই ফোন দেন। রক্তদাতা আনা-নেওয়ার মাধ্যমে ঐ ভাইটির সাথে আমার পরিচয় হয়।
উনি মোবাইল ফোনে আমাকে বলেন, ❝ভাইয়া, এক বৃদ্ধ মায়ের জরায়ু টিউমার অপারেশন করা হবে। দুর্লভ দুই ব্যাগ O- নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন। প্লিজ একটু যোগাড় করে দাও না।❞

আমি বলেছিলাম ঠিক আছে ভাইয়া দেখি চেষ্টা করবো।
উনি বললেন, তুমিই শেষ ভরসা। তোমাকেই ম্যানেজ করে দিতে হবে। আমরা অনেক জায়গায় খুঁজেছি কিন্তু পাই নাই।

উনি যেদিন জানালেন তার পাঁচ দিনের মাথায় অপারেশন করা হবে। আমি ঐ সময় ঠাকুরগাঁওয়ে আমার ম্যাচে ছিলাম। খবর নেওয়া শুরু করলাম। একটা সময় আমার আটোয়ারী উপজেলা টিমের সহযোদ্ধা ও প্রিয় বন্ধু পলাশ কে ফোন দেই। সে জানালো একজন আছে রক্তটা দিবে ইনশাআল্লাহ। আমিও কর্নফাম হয়ে রোগীর লোককে কথা দিয়ে দেই।

চারদিন কেটে গেলো।
আমি কলেজে ক্লাসে ছিলাম। হঠাৎ করে আটোয়ারী থেকে বিপ্লব নামে এক ভাই ফোনে জানালেন জরুরি ভিত্তিতে এক বৃদ্ধ চাচার জন্য O-নেগেটিভ রক্ত লাগবে, উনার হিমোগ্লোবিন ৩০% এর নিচে নেমে গেছে। রক্তটা দিতে না পারলে কিছু একটা হয়ে যাবে…।
কি আর করার! আমি ঠাকুরগাঁও থেকে আমার বন্ধু পলাশ কে ফোনে বললাম ডোনার নিয়ে আটোয়ারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাও ওখানে রোগী বসে আছে।
ও বলে বোদার রোগীটার কি হবে তখন? আমি বলি সেটা পরে দেখা যাবে। রোগীর লোকও তো পরবর্তীতে আমাদের সাথে আর যোগাযোগ করে নাই। ডোনার কে নিয়ে ও আটোয়ারী যায়। যাওয়ার পরে বন্ধু পলাশ ফোন দিয়ে বলে “তুমি না আসলে ডোনার রক্ত দিবেনা, তোমাকে সাথে থাকতে হবে!” পরলাম আরেক মহা ঝামেলায়! এদিকে রোগীর লোক বারবার ফোন দিচ্ছে ভাই তারাতাড়ি আসেন আমার রোগীটাকে বাঁচান! কি আর করার, ক্লাস চলাকালীন ছুটি নিয়ে ঠাকুরগাঁও জেলা থেকে ৩০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে আসলাম। আসার পরে বাকি সব কাজ শেষ করে রক্তটা দেওয়া হলো। রোগীর লোকজনও স্বস্তি ফিরে পেলেন।

ডোনার রোজা থাকার কারনে রোগীর লোকজন খুব করে আপ্যায়ন করতে চাইলেও সম্ভব হলো না।
রক্তটা দেওয়া শেষে যে যার মতো বাড়িতে চলে গেলাম।
সন্ধ্যার দিকে বোদা থেকে ফোন আসে! আমি বললাম কাম সারছে! এইবার কি হবে! ফোনটা ধরলাম। সালাম দিয়ে বললেন “ভাইয়া, কালকে আসতেছেন তো?”
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে উনাকে সব ঘটনা খুলে বললাম। উনি অনেকটা মন খারাপ করেছেন, কথা গুলো শুনেই বুঝতে পারলাম। উনাকে আস্বস্ত করে বললাম- ভাই, ভরসা রাখেন আপনারা অপারেশনের ব্যবস্থা করেন, আমি ডোনার নিয়ে যাবো কথা শেষ।
এর মাঝেই রাতে বি পজিটিভ ডোনার নিয়ে পঞ্চগড় শহরে যাই একটা এক্সিডেন্ট রোগীর জন্য। বোদা থেকে আবার ফোন! এই বার পরে গেলাম প্যারায়! ডোনার তো এখনো পাইলাম না। রাত পোহালেই তাদের অপারেশন। আমার বন্ধু পলাশ আমার সাথেই ছিলো। তাকে বললাম বন্ধু দেখ কি করা যায়। ও খুঁজতে খুঁজতে একটা ছেলে কে পেলো। রাত বাজে তখন ৮ টা। একটু স্বস্তি পেলাম। ঘন্টা খানেক পর সেই ছেলেটি ফোন দিয়ে বলে সে রক্ত দিতে পারবে না! মাথায় তো আকাশ ভেঙে পরলো। উপায় না পেয়ে আটোয়ারী উপজেলার ভলান্টিয়ার সহ আমার সকল বন্ধুদের ফোন করা শুরু করি। তারপর আমি, পলাশ, শাহিনুর, রকি, শামীম সহ রাত ৯:৩০ এর দিকে সবাই এক জায়গায় একটা মিটিং করে রক্ত খোঁজা শুরু করি।
হাজার টা ফোন কল করা শেষ! রাত ১১.৩০ বেজে গেলো। রক্তদাতার কোন ব্যবস্থাই হলো না। তারপর যে ছেলেটি দিতে চেয়েছিলো সর্দার পাড়া নামক এলাকায় তার বাড়ি। রাত ১১.৩০, দুইটা বাইক নিয়ে ঐ ছেলের বাড়িতে আমরা যাই। আমরা ছেলেটিকে অনেক বুঝালাম কোন কাজ হলো না।
সবার মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ। এতো চেষ্টা করার পরেও কিছু করতে পারলাম না। এদিকে তখন রাত ১২ টা পার হয়ে গেছে। সবাইকে বাড়ি থেকে ফোন দেওয়া শুরু করছে। সবাইকে বললাম রাত হয়ে গেছে অনেক বাড়ি চলে যাও। যে যার মতো চলে গেলো। আমি বাড়ি এসে আর ঘুমাতে পারলাম না। সারারাত কারো না কারো সাথে যোগাযোগ করেই গেলাম। এদিকে তখন সেহরির সময় হয়ে গেছে। সেহেরি সেরে শেষ বারের মতো আমার এক সুপরিচিত ছোট ভাই জমির, তাকে আদর করে মামু বলে ডাকি। তাকে ফোন দিয়ে বললাম মামু এই এই ঘটনা! ও বললো আচ্ছা দেখি পাইলে জানাবো।
পরে আমি ঘুমিয়ে পড়ি। দুপুর দুইটা পার হয়ে গেলো, কারোও কোন খবর নাই। কিছুক্ষণ পরে জমির ফোনে জানায় ❝মামু একজন পাইছি।❞ বললাম আলহামদুলিল্লাহ! সে জানালো ছেলেটি রোজা আছে, ইফতার শেষে দিবে। বললাম সমস্যা নাই। তখনও মনের মধ্যে একটা কিন্তু আছেই যদি পরে আবার না করে দেয়! ইফতার শেষে রোগীর লোকের ফোনের উপর ফোন কল! ভাই তারাতাড়ি আসেন অপারেশন শুরু হচ্ছে না ডক্টর চলে এসেছেন। আমি ডোনারকে নেওয়ার জন্য তখন আটোয়ারী বাজারে বসে আছি। ডোনার আসলো। নিজের ভিতরে যে তখন কতটা আনন্দ কাজ করতেছিলো তা বলে বুঝাতে পারবো না। দিন শেষে আমরা কষ্টটা সাধন করতে পারলাম।

তবে এই ডোনার টা খোঁজার পেছনে আমার আটোয়ারী উপজেলার সহযোদ্ধা, বন্ধু, ছোট ভাই, বড় ভাই সবাই অনেক কষ্ট করেছেন। আমার জন্য সেদিন তাদের ভালোবাসা দেখেছি। নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা তারা কাজে লাগিয়েছে সেদিন।
সমস্ত ক্রেডিট তাদেরই। আর হ্যাঁ,  এক ব্যাগেই কাজ হয়ে গেছে। এটা ছিলো ঐ রক্তদাতার প্রথম রক্তদান।অপারেশন সাকসেসফুলি সাকসেসফুল!

আমরা রক্তবন্ধু, রক্তের সম্পর্ক গড়ি।

মহান এই রক্তদাতার নাম বাদল, বাড়ি আটোয়ারী উপজেলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে।

প্রথম বারের মতো রক্তদান করছেন বাদল

শ্রমজীবী এই মানুষটি লেবার অর্থাৎ রাজমিস্ত্রির হেলপার হিসেবে কাজ করেন। নির্মাণ শ্রমিকদের আমাদের এলাকায় বলি “রাজের কাজ করে”।

কঠোর কায়িক পরিশ্রমী এই মানুষদের জন্য অন্য সময়েও রক্তদান খুব কঠিন একটি কাজ। কেননা রক্তদান করে কমপক্ষে ২-১ দিন ভারী কাজ করা নিষেধ। সেখানে তিনি রোজা রেখে কাজ করে ক্লান্ত শরীরে ইফতারের পর রাজকীয় ভাবে উপস্থিত হয়ে রক্তদান করে ফেললেন অন্যের জীবন বাঁচানোর প্রশ্নে, নিঃস্বার্থে।

কেউ দিলেই তবে অন্য কেউ রক্তটা পায়।
আসুন নিজেও রক্তদানে এগিয়ে আসি।
নিজেদের প্রয়োজনে শুধু অন্যের কাছে খুঁজবো কিন্তু অন্যের প্রয়োজনে দিবো না এতোটা স্বার্থপর হওয়া ঠিক না।

স্বেচ্ছায় রক্তদানে আগ্রহীগণ রেজিস্ট্রেশন করুন।
roktobondhu.com

আবু হাসান বাবু ( বি পজিটিভ)
সমন্বয়ক, রক্তবন্ধু আটোয়ারী উপজেলা।
পঞ্চগড়।


শেয়ার করুন: