থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ কর্মপরিকল্পনা

শেয়ার করুন:

থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ কর্মপরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত?

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন

আজ থেকে ২৮ বছর আগে (১৯৯৪) থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস ঘোষণা করা হলেও শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য রোগটি বাংলাদেশে অপরিচিত এবং অবহেলিতই রয়ে গেছে। ২০০৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থ্যালাসেমিয়াকে বিশ্বের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম থ্যালাসেমিয়া ঝুঁকিপূর্ণ (হটস্পট) দেশ হওয়া সত্ত্বেও এ নীরব ঘাতক প্রতিরোধ এবং রোগীদের সাপোর্ট সিস্টেম তৈরির জন্য দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, দেশে এখন পর্যন্ত থ্যালাসেমিয়াকে জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবেও স্বীকৃতি দেয়া হয়নি।

থ্যালাসেমিয়া কী এবং তা কেন হয়?

এটি সাধারণত অনিরাময়যোগ্য বংশগত (জিনগত) রক্তরোগ। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত রোগীর দেহে লোহিত রক্তকণিকা ঠিকমতো তৈরি হতে পারে না। ফলে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায়। শিশুর জন্মের কয়েক মাস বা বছরের মধ্যে রোগটির লক্ষণ (যেমন ক্লান্তি, অবসাদ, শ্বাসকষ্ট, ফ্যাকাশে ত্বক ইত্যাদি) দেখা দেয়। রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে জন্ডিস দেখা দেয়। প্লীহা বড় হয়ে যায়, এমনকি যকৃৎও বড় হয়ে যেতে পারে। দিন দিন এ রোগের জটিলতা বাড়তে থাকে, শারীরিক বৃদ্ধি প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হতে পারে। পর্যাপ্ত রক্ত সঞ্চালনের অভাব এবং অপ্রতুল বা বিনা চিকিৎসার কারণে আমাদের দেশে বেশির ভাগ রোগী ১০-১৫ বছর বয়সের মধ্যে মারা যায়।

দুজন থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সন্তানের রোগটি দেখা দিতে পারে। বাহকরা সাধারণত সুস্থ, তাদের তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এ কারণে অনেকেই বুঝতে পারেন না তিনি থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। তাই যথেষ্ট সচেতন (নিজে বাহক কিনা তা জানতে জীবনে একটি টেস্ট—হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস করা এবং দুজন বাহক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া) হলে দুরারোগ্য ব্যাধি, যেমন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের তুলনায় থ্যালাসেমিয়া খুব কম খরচে এবং নিশ্চিতভাবে প্রতিরোধ করা যায়।

বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে।

থ্যালাসেমিয়া এতই অবহেলিত যে মাত্র কয়েক বছর ধরে রোগটি নিয়ে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালে নন-প্রফিট চ্যারিটেবল সংস্থা, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (বিআরএফ) ও বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে দেশে এ রোগের সার্বিক অবস্থা নিয়ে আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য জার্নালে (অরফানেট জার্নাল অব রেয়ার ডিজিজেস) প্রথম একটি কম্প্রিহেনসিভ আর্টিকেল প্রকাশিত হয়। আমাদের গবেষণা এবং সাম্প্রতিককালে আরেকটি প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১০-১২ শতাংশ মানুষ এ রোগের বাহক। অর্থাৎ প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি (২০ মিলিয়ন) মানুষ নিজের অজান্তেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক এবং দেশে কমপক্ষে ৬০-৭০ হাজার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু-কিশোর রয়েছে। শুধু অসচেতনতার কারণে সহজে প্রতিরোধযোগ্য রোগটি নিয়ে প্রতি বছর প্রায় ৭ থেকে ১০ হাজার শিশু জন্মগ্রহণ করছে।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া উপজাতি শিক্ষার্থী থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বেশির ভাগ এ রোগের নামই শোনেননি।

কয়েক দশক ধরে দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতির কারণে পাঁচ বছরের অনূর্ধ্ব শিশুমৃত্যুর হার অনেকাংশে কমানোর সফলতার কারণে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে এবং অসচেতনতার কারণে এ রোগের বাহকের সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় ৭০ শতাংশ কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থী (যা ভবিষ্যতে পরিবার গঠন করবে) এ রোগের নামই শোনেনি, যা বিআরএফ পরিচালিত আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে।

থ্যালাসেমিয়া—কেন এক বিভীষিকার নাম?

মোটাদাগে সে সমস্যাগুলো দেশের থ্যালাসেমিয়া রোগী এবং তাদের পরিবারকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয়, এ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরছি। এতে এ রোগের ব্যাপকতা সম্পর্কে অনুধাবন করা সহজ হবে।

১. নিয়মিত রক্ত জোগাড় করা বড় একটি সমস্যা: রক্ত পরিসঞ্চালননির্ভর (ট্রান্সফিউশন ডিপেন্ডেন্ট) থ্যালাসেমিয়া রোগীরা যতদিন বাঁচে ততদিন পর্যন্ত অন্যের দান করা রক্ত গ্রহণ করতে হয়। বিআরএফ ও বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালের যৌথ গবেষণা অনুযায়ী, ৪০ শতাংশের বেশি রোগীকে প্রতি মাসে এক থেকে চারবার রক্ত পরিসঞ্চালন করতে হয়। এ স্টাডি অনুযায়ী ঢাকায় চিকিৎসা করতে সামর্থ্যবান রোগী পরিবারের ৭৭ শতাংশ সন্তানের জন্য নিয়মিত রক্ত জোগাড় করতে সমস্যার মুখোমুখি হয়। দেশের রক্তদাতা সংগঠনগুলো থেকে তারা (৭৮%) আশানুরূপ সাপোর্ট পায় না। জেলা শহর পর্যায়ে রক্তদাতার তীব্র সংকট বাংলাদেশে। স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংস্থা বা ক্লাবগুলোর কার্যক্রম সাধারণত শহর বা শহর এলাকায় সীমাবদ্ধ। রক্তদান কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে মূলত রক্ত সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জেলা পর্যায়ের ব্লাড ব্যাংকে সংরক্ষিত রক্ত বেশিদিন রাখা যায় না। অপর্যাপ্তভাবে সংরক্ষিত রক্ত দিয়ে পরিসঞ্চালন করলে ইমিউনোলজিক্যাল রিঅ্যাকশনের কারণে রোগী মারা যেতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে মাত্র ৩১ ভাগ রক্ত সংগ্রহ করা হয় স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার মাধ্যমে। দক্ষিণ এশিয়ায় স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতার সংখ্যা বাংলাদেশে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। করোনা অতিমারীর সময় রোগীরা রক্ত জোগাড় করা এবং চিকিৎসা নিতে চরম সংকটে পড়েছিল, যা আমাদের মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় জানা গেছে। লকডাউন ও করোনা সংক্রমণের আতঙ্কের কারণে রক্তদাতারা রক্ত দান করতে আগ্রহী ছিলেন না।

২. অপ্রতুল বা বিনা চিকিৎসায় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের মৃত্যুর সঙ্গে জীবনভর লড়াই: নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন, দেহ থেকে অতিরিক্ত জমাকৃত আয়রন অপসারণ (এজন্য প্রতিনিয়ত দামি ওষুধ সেবন) এবং বিভিন্ন জটিলতার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অধীনে থ্যালাসেমিয়া রোগীকে সারা জীবন ট্রিটমেন্ট নিতে হয়। উন্নত দেশে থ্যালাসেমিয়ার উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য রোগীরা জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীর চিকিৎসা মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। জেলা পর্যায়ে চিকিৎসার সুযোগ এখনো তৈরি হয়নি। প্রসঙ্গত, দেশের বেশির ভাগ জেলায় রক্তরোগ বিশেষজ্ঞের (হেমাটোলজিস্ট) চরম সংকট। এমনকি জেলা শহর পর্যায়ে বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন রক্ত পরিসঞ্চালন করার তেমন সুব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। এসব কারণে শুধু অর্থনৈতিকভাবে মোটামুটি সামর্থ্যবান পরিবার থ্যালাসেমিয়া রোগীর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা সেবা দিতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত। তাই দেশের সিংহভাগ রোগী বিনা চিকিৎসায় অথবা রোগটি যে তাদের হয়েছিল, তা না জেনেই ধুঁকে ধুঁকে মারা যায়।

৩. অর্থনৈতিক ও মানসিক সমস্যায় জর্জরিত: বাংলাদেশে প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য নিয়মিত (মাসে ১ থেকে ৪ ব্যাগ) রক্ত জোগাড় করার পাশাপাশি চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে প্রায় ১০-২৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়, যা বেশির ভাগ পরিবারের সাধ্যের বাইরে। এ কারণে রোগীর পাশাপাশি পুরো পরিবার মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

৪. অনুশোচনা ও সামাজিক অবজ্ঞার শিকার: ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া সমিতি হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের নিয়ে আমাদের গবেষণা অনুযায়ী প্রায় ৯০ শতাংশ মা-বাবা এ রোগ হওয়ার জন্য নিজেদের দোষী মনে করে তীব্র অনুশোচনায় ভোগেন। সন্তানের এ রোগ ধরা পড়ার আগে ৯৭ শতাংশ মা-বাবা থ্যালাসেমিয়ার নাম শোনেননি। ৪০ শতাংশ ভুক্তভোগী মা-বাবা সামাজিকভাবে অপবাদ বা বঞ্চনার শিকার হন। গ্রামাঞ্চলে রক্ত সংগ্রহ করা নিয়েও নিগ্রহের শিকার হতে হয়। অসচেতনতা, ভুল তথ্য ও কুসংস্কারের কারণে থ্যালাসেমিয়া রোগকে ‘রক্তের দোষ’ হিসেবে গণ্য করে পরিবারকে একঘরে করার ঘটনাও ঘটে।

৫. রোগীদের বিয়ে ও ক্যারিয়ার গঠনের অনিশ্চয়তা: প্রতিনিয়ত রক্ত জোগাড় করার অনিশ্চয়তা নিয়ে রোগীরা সবসময় বিচলিত থাকে। নাকের হাড় দেবে যাওয়া, মুখের গড়নে পরিবর্তন তথা দেহের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এ কারণে কোনো কোনো থ্যালাসেমিয়া রোগীকে—মেধাবী গ্র্যাজুয়েট—নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান চাকরিতে নিতে অনীহা প্রকাশ করে। তাদের পরিবার গঠন নিয়েও চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

২য় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন 

ড. মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন: নির্বাহী পরিচালক, বায়োমেডিকেল রিসার্চ ফাউন্ডেশন (বিআরএফ), বাংলাদেশ

সহযোগী অধ্যাপক, ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ (আইইউবি)

[email protected]


শেয়ার করুন: